ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল

মানবসেবার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন যে নারী

ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এমন একটি নাম, যা মানবসেবার দিক ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। রোগীর সেবা যা ছিল সে সময়ের ইউরোপের সমাজের নিচুমানের একটা পেশা, তা এই একটি মানুষের প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীতে হয়ে ওঠে সবচেয়ে সম্মানজনক পেশাগুলোর একটি। ‘নার্সিং’কে তিনি শুধু একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করেননি, রেখে গিয়েছেন সেবার যথাযথ মানোন্নয়নের জন্য তাঁর পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ নির্দেশনাসমূহও।

সেবার প্রতি তাঁর হৃদয়ের আহ্বানে পরিবার ও সমাজের সব প্রতিকূলতা তুচ্ছ করে কীভাবে তিনি নিজ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। আমরা পরিচিত হয়েছি তাঁর অদম্য মনোবল আর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির সাথে, জেনেছি কীভাবে তিনি মাড়িয়ে গিয়েছেন সেসব কিছু, যা তিনি তাঁর এই সুমহান ব্রতের সামনে বাধা ভেবেছিলেন। আর তাঁর সেই আজীবন অক্লান্ত সাধনা, অবিশ্রান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে পৃথিবীর মুমূর্ষু প্রাণ সেবার নতুন আলো দেখতে পায়।

নাইটিংগেলের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিলো ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিপর্যস্ত সৈন্যদের সেবায় তাঁর অসামান্য সাফল্য। ১৮৫৩ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে ১৮৫৪ সালের মধ্যে ১৮ হাজারেরও বেশি সৈন্য মিলিটারী হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে সেসব অক্ষম সৈন্য চরম নিগ্রহের মধ্যে থাকতো। না ছিল তাদের জন্য কোনো নার্সের ব্যবস্থা, না ছিল প্রয়োজনীয় ওষুধসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের যথেষ্ট বরাদ্দ। যুদ্ধের ময়দানের চেয়ে বেশি সৈন্য মারা যাচ্ছিলো ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ও অন্যান্য বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে। এমন অবস্থা যখন দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে, তখন নিজেই দল গঠন করে এগিয়ে এলেন ৩৪ বছরের এই অভিজাত সুন্দরী নারী। বিভিন্ন হাসপাতালে ও সেবাকেন্দ্রে তাঁর আগের অভিজ্ঞতা সেই কঠিন পথচলায় সহায়ক হয়।

দীর্ঘ পথের অবসাদের পর নাইটিংগেল ও তাঁর দল যখন স্কুটারির প্রান্তরে এসে পৌঁছালেন, তখন দেখলেন সেখানে নেই ওষুধ, সুষম খাবার, রোগীর পরবার জন্য পরিষ্কার কাপড় আর দরকারি কোনোকিছুই। এমনকি পানযোগ্য পানি পর্যন্ত নেই। পথশ্রমে সবাই যখন ক্লান্ত অবসন্ন, ফ্লোরেন্স তখন মুহূর্তের জন্য দেরি করলেন না, প্রথমেই গেলেন হাসপাতাল পরিদর্শনে। সেখানকার ভারপ্রাপ্ত একজন অফিসার তাঁকে বলেছিলেন- “এখানে কোনোকিছুরই অভাব নেই”, কিন্তু ফ্লোরেন্স দেখলেন চারপাশে শুধু অভাব আর অভাব। সামরিক ভান্ডারে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস থাকার পরও নানা বিধি-নিষেধের কারণে কিছুই পেলেন না তিনি। অগত্যা যা নিয়ে এসেছিলেন তাই দিয়ে কাজ শুরু করলেন।

প্রথমেই শুরু করলেন হাসপাতাল পরিষ্কার করার কাজ। হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার করার মতো ঝাড়ু বা কাপড়ও ছিল না তখন। কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা না করে ফ্লোরেন্স নিজেই সব ব্যবস্থা করা শুরু করেন। এমনকি রোগীদের পরার পরিষ্কার কাপড়ের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি নিজেই লন্ড্রি খুলে ফেলেন। এর মাঝে সংবাদপত্র ‘দি টাইমস’ এর মাধ্যমে তিনি সাহায্যের আবেদনও পাঠান। ধীরে ধীরে পোশাক, তোয়ালে আসতে শুরু করে। ফ্লোরেন্স আদেশ দিলেন জিনিসপত্র আসা মাত্রই তা যেন খুলে ফেলা হয়। ফ্লোরেন্সের কর্মনিষ্ঠা আর আত্মত্যাগ সবাইকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে তুললো।

ফ্লোরেন্স হাসপাতালের পরিচালনা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনলেন। যেসব কর্মচারীরা হাসপাতালের কাজের উপযুক্ত নয় বলে তিনি বিবেচনা করলেন, তাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন দয়ার প্রতিমূর্তি, আরেকদিকে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। এক বন্ধুকে তখন চিঠিতে লেখেন- “যে সমস্ত লোক মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে পারবে, কিন্তু সরকারি কেতা-কানুন ভেঙে একটা ঝাঁটাও দেবে না, তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই।

নাইটিংগেলের আরেকটি বড় অবদান ছিলো সারা দেশে এবং বাইরে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস চালু করা। এর শুরু হয়েছিল ওই স্কুটারের প্রান্তরেই। তিনি হাসপাতালের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর চেষ্টার মাধ্যমে হাসপাতালের কাঠামোর পর্যন্ত পরিবর্তন করেন। তাঁর এই আপ্রাণ চেষ্টার ফলে সৈন্যদের মৃত্যুহার ৪২% থেকে ২%-এ নেমে আসে, যা মাইলফলক হয়ে থাকবে মানবসেবার ইতিহাসে।

নাইটিংগেল তাঁর কাজকে শুধু যুদ্ধাহতদের সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি দেশে ফিরে রানীর কাছে তাঁর কাজের সম্মান হিসেবে বহুমূল্য একটা ব্রোচসহ সরকারের কাছে থেকে পান ২,৫০,০০০ ইউএস ডলার। এছাড়া ‘নাইটিংগেল ফান্ড’ এর মাধ্যমে যোগার করেন ৪৫,০০০ ডলারের মতো। তাঁর পরিচিত বিভিন্ন উচ্চপদস্থ মানুষের কাছে থেকে পেলেন বিভিন্ন সহযোগিতা। এগুলোর দিয়ে আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রথম নার্সিং স্কুল- ‘নাইটিংগেল ট্রেনিং স্কুল ফর নার্সেস’। তাঁর কাছে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নার্সরা ছড়িয়ে গেলেন বিভিন্ন জায়গায় ও দেশে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তাঁর কাছে থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণের সাহায্যেই আমেরিকায় উপযুক্ত নার্সিং প্রথা চালু করা হয়। ভারতেও তিনি পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়ান, যদিও তিনি নিজে কখনো ভারতে আসেননি। তাঁর লেখা ‘Notes On Nursing’, ‘Notes On Hospital’ ও বিভিন্ন তথ্যবহুল নোট আধুনিক নার্সিং শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে।

এতোদিনে ফ্লোরেন্স হয়ে ওঠেন মানবসেবায় অনুপ্রেরণার আরেক নাম। দলে দলে সকল স্তরের মেয়েরা নার্সিংকে পেশা হিসাবে নিতে শুরু করে। ১৯০৭ সালে তিনি প্রথম নারী হিসেবে ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লন্ডন’ সহ পরে আরো অনেক সম্মানজনক পুরষ্কার পান।

ব্যক্তিগত জীবনে ফ্লোরেন্স ঘর-সংসার করেননি, তিনি ভেবেছিলেন সেদিকে মনোযোগ দিলে তা তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই অপূর্ব সুন্দরী সেই তরুণী সমাজের সবচেয়ে ধনী ও যোগ্য পাত্রদের মধ্যে অনেকের লোভনীয় বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধনী রাজনীতিবিদ ও কবি রিচার্ড মোঙ্কটন মিলন্সের সাথে ৯ বছরের বাগদানের পরও বিয়ে না করা। ফ্লোরেন্স বলেছিলেন বিয়ে ও সংসার নার্সিংয়ের জন্য তাঁর কার্যক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দেবে। আবার নাইটিংগেল তখনকার নারী অধিকার আন্দোলনেরও সমালোচনা করে বলেছিলেন- “মেয়েরা সহানুভূতির আশা করে, কিন্তু নিজেদেরকে পুরুষের মতো যোগ্য করে গড়ে তোলে না।” ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি তখনকার সম্ভ্রান্ত মহিলাদের চেয়ে বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান ও অনুপ্রেরণা দানকারী পুরুষের বন্ধুত্বই বেশি পছন্দ করতেন। মহিলা বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীও তাঁর ছিল, কিন্তু তাঁরা ম্যারি ক্লার্কের মতোই স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ।

এরপর একদিন যেভাবে নীরবে তিনি এসেছিলেন, সেভাবে নীরবেই তিনি বিদায় নেন। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ঘুমের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খুব সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গবেষক দাবি করেন, তিনি ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত ছিলেন, যা ‘ক্রিমিয়ার জ্বর’ নামেও পরিচিত। সারা জীবনের মতো জীবনের শেষেও সামাজিক লৌকিকতা আর আড়ম্বর তার অপছন্দ ছিল। তাই তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর পরিবার সরকার থেকে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠান প্রত্যাখান করে খুবই সাধারণভাবে চার্চের পাশে তাঁকে সমাহিত করে। কতই না সাধারণ ছিলেন এই অসাধারণ মানবী!


Riaz Ahamad

8 Blog posts

Comments
Binku Mukherjee 2 yrs

খুব ভালো ..

 
 
James Boss 2 yrs

Nice writing