শিশুরা বেশি আক্রান্ত, শয্যাসংকট
***********************************************************************
বরিশাল শহরের নবগ্রাম এলাকার শারমিন আক্তারের সাড়ে চার বছর বয়সী মেয়ে রামিশার নিউমোনিয়া। শয্যা না পাওয়ায় দুদিন ধরে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে রামিশা। শারমিন বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতিদিন ঠান্ডা নিয়ে এত অসুস্থ বাচ্চা আসছে, ভাবা যায় না। কোনো সিট খালি নাই।’

রাজধানীসহ সারা দেশে শীতে শিশুদের ঠান্ডাজনিত রোগ বাড়তে শুরু করেছে। হাসপাতালগুলোতে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, এর বড় অংশই শিশু। নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রভাবে ৩০টির বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দাতেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এতে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের কষ্ট বেশি হচ্ছে। যাঁরা এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের বড় অংশ দরিদ্র। চিকিৎসকেরা বলছেন, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিশুরা দ্রুত নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

শয্যাসংকট
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ দিনে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৩৩ জন। এর বড় অংশ শিশু। এই পাঁচ দিনে হাসপাতালে মারা গেছে তিনটি শিশু। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডটি ৩৬ শয্যার হলেও সেখানে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ১৩২ জন। ফলে বেশির ভাগ শিশুকে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শীতের শুরু থেকে ঠান্ডাজনিত রোগী বেড়েছে। শিশু ওয়ার্ডের শয্যাসংখ্যা অপ্রতুল। এত রোগী আসছে যে সবাইকে শয্যা দেওয়া যাচ্ছে না। শিশু বিভাগে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি শিশু ওয়ার্ডে শয্যা ১৭৮টি। সেখানে গত বৃহস্পতিবার ৪৫০ রোগী ভর্তি ছিল। স্বাভাবিক সময়ে এই দুই ওয়ার্ডে শিশু রোগী ভর্তি থাকে ২০০-২৫০টি। ভর্তি হওয়া এসব রোগীর মধ্যে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৫টি শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বয়স ১৯ দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা এলাকার মৌসুমী আক্তার তাঁর পাঁচ মাস বয়সী ছেলেসন্তানকে ১ জানুয়ারি রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করেছেন। শ্বাসকষ্ট কমাতে নেবুলাইজার দিয়ে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। মৌসুমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠান্ডা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ওষুধ খাওয়ানোর পরও সুস্থ না হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।’

রংপুর মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ফখরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঠান্ডাজনিত রোগে শিশুরা বেশি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। শয্যার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি শিশু ভর্তি আছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বেশির ভাগই গ্রাম থেকে আসা। এসব হতদরিদ্র পরিবারের সচেতনতার অভাব রয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৫০০টি। গত বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত সেখানে রোগী ভর্তি ছিল ১ হাজার ২২০ জন। শয্যা না থাকায় হাসপাতালের চলাচলের করিডর ও বারান্দার মেঝেতে রোগীরা থাকছেন। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডের অবস্থা করুণ। বাতাসের প্রবেশ ঠেকাতে ওই ওয়ার্ডের বারান্দার ফাঁকা জায়গা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শিশুদের নিয়ে কষ্ট করছেন স্বজনেরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, শীতের তীব্রতা বাড়ার কারণে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু বেশি। গত বুধবার সকাল সাতটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটা পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ২৭১ জন। ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৪১টি শিশু। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১৫ জন, যার ৬টি শিশু।

ওই ওয়ার্ডের বারান্দায় কথা হয় দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়ন থেকে আসা জেসমিন বেগমের সঙ্গে। তিনি তাঁর ১ মাস ১৯ দিন বয়সের নাতিকে নিয়ে ওই হাসপাতালে এসেছেন। জেসমিন বেগম বলেন, শিশুটির চার দিন আগে থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, নিউমোনিয়া হয়েছে। আরও কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছেন।

সব ওয়ার্ডেই ঠান্ডাজনিত রোগী
রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বর্তমানে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, এর বড় অংশ ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে সাতটি শিশুকে নিয়ে স্বজনেরা অপেক্ষা করছেন।

এর মধ্যে পাঁচটি শিশুই এসেছে ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গতকাল ১৫টি শিশু ভর্তি ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় সব ওয়ার্ডেই এখন ঠান্ডাজনিত রোগী ভর্তি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে ১ মাস ৬ দিন বয়সী নাঈমকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। টঙ্গীর কামারপাড়া থেকে হাসপাতালে আসা নাঈমের মা নীলা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আগে অন্য হাসপাতালে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে শিশু হাসপাতালে পাঠিয়েছে।’

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছে ১৮টি শিশু, যার অধিকাংশই ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছে। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ভর্তি রোগী ছিল ৩৬ জন।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক টিটো মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাপমাত্রা হঠাৎ কমায় শিশুদের ঠান্ডাজনিত রোগ বাড়ছে। নিউমোনিয়া, অ্যাজমার পাশাপাশি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সমস্যা হচ্ছে। শীত থেকে যতটা সম্ভব নিরাপদে থাকতে হবে। গরম কাপড় ব্যবহার ও শিশুদের বাইরে যতটা কম নেওয়া যায়, তত ভালো। ঠান্ডার সমস্যা দেখা দেওয়ামাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Source: প্রথম আলো

image