খাবার মেন্যুতে অন্য যাই থাক না কেন, মাংস মুখে না দেওয়া পর্যন্ত কোরবানি ঈদ যেন শুরুই হয় না। গরুর মাংসের ক্ষতিকর দিক যেমন আছে, তেমনি এই মাংস অনেক উপকারও করে থাকে। মাংস হচ্ছে প্রাণীজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে রয়েছে ২৬ গ্রাম প্রোটিন। এই প্রোটিন শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি সাধন ও দেহ গঠন করে। নতুন কোষ গঠন করে ক্ষয়পূরণ করতে ও কোনো ক্ষতস্থান সারাতে প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। যখন দেহে চর্বি ও শর্করার অভাব দেখা যায়, তখন প্রোটিন শক্তি উৎপাদনের কাজ করে। রোগ সৃষ্টিকারী রোগ জীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। মানসিক বিকাশ বা মস্তিস্কের বিকাশের জন্য প্রোটিন অপরিহার্য। তাছাড়া গরুর মাংস আয়রন, জিঙ্ক, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন বি-১২-এর অন্যতম উৎস। এই উপকারী মিনারেল ও ভিটামিনগুলো পেশি, দাঁত ও হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে, ত্বক, চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, শরীরের বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখে, শরীরের অসাড়তা দূর করে কর্মোদ্যম রাখে।
প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদা নির্ভর করে আপনার ওজনের ওপর। তবে ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মতে, কারোরই প্রতিদিন ৭০ গ্রামের বেশি এবং সপ্তাহে ৫০০ গ্রামের বেশি প্রোটিন খাওয়া উচিত নয়। তাই একজন মানুষ দৈনিক ৫০-৭০ গ্রাম বা সপ্তাহে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম মাংস খেতে পারবেন। কিন্তু স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকায় অতি ভোজনে বিপদ হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে ২.৫ গ্রাম। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র অনুযায়ী, দৈনিক ২০০০ ক্যালরি চাহিদাসম্পন্ন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ প্রতিদিন প্রায় ১৩ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ করতে পারবেন। কেবল গরুর মাংসেই যে এই ফ্যাট রয়েছে তা কিন্তু নয়। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অন্যান্য উৎসেও এর উপস্থিতি রয়েছে। এর প্রভাবে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বাড়ে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সারের ঝুঁকি। তাই যাদের ডায়াবেটিস, ডিসলিপিডেমিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের পূর্ব ইতিহাস বা পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাদের অবশ্যই বিশেষ সতর্কতা পালন করতে হবে।
* মাংস কাটার সময় দৃশ্যমান চর্বি আলাদা করে ফেলে দিন। মাংস পাতলা ও ছোট টুকরা করুন। এতে চর্বি কমে যাবে।
* কোরবানির মাংস রান্না করার সময় বেশি তেল দিয়ে ভুনা না করে অল্প তেলে রান্না করুন।
* উচ্চ তাপে দীর্ঘ সময় ধরে মাংস রান্না করলে এতে পলিসাইক্লিক হাইড্রোকার্বন ও হেটেরোসাইক্লিক অ্যামাইন-জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক তৈরি হয়। তাই মাংস রান্নার সময় অল্প তাপে রান্না করুন।
* মাংস রান্নার আগে সিদ্ধ করে পানি ফেলে নিন। এতে মাংসের চর্বি অনেকটাই কমে আসে।
* রান্না করা মাংস বারবার গরম করবেন না। এতে মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়, ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়।
* কলিজা, মগজ, পায়া খাবেন না। কারণ এতে ক্ষতিকর চর্বি অধিক মাত্রায় থাকে।
* পাতে শুধু মাংস নয়, সালাদ আর সবজির জোগান থাকা চাই।
* কোল্ড ড্রিংকস, ডেজার্টের পরিবর্তে মাঠা, জিরা পানি বা টকদই রাখুন।
* উৎসব-আনন্দে নিয়মিত ওষুধ সেবন যেন বাদ না পড়ে। নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা বাদ দেবেন না।
* ডায়াবেটিস রোগীরা কোনো অবস্থাতেই চিনি-গুড়ের তৈরি সেমাই, পায়েস, জর্দা বা অন্যান্য মিষ্টান্ন খাবেন না।
* কিডনি জটিলতা ও ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাংস খাবেন।
কিছুটা নিয়ম মেনে তাই পরিমিত মাত্রায় মাংস খেলে ঝুঁকির পরিমাণটা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। পরিমিত, পুষ্টিসমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর খাবারের সঙ্গে ঈদকে করে তুলুন আনন্দময়।
লেখক: ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, কনসালট্যান্ট, সিডব্লিউসিএইচ; ইমপালস হাসপাতাল, তেজগাঁও, ঢাকা।