"সেদিন ছিল আমাদের বিবাহিত জীবনের এক কালো অধ্যায়। প্রথমবার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিলাম। সে শুধু চুপচাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। ঠোঁটের কোণে রক্তের বিন্দু জমে উঠেছিল—কিন্তু একটাও শব্দ করেনি। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, অথচ কোনো প্রতিবাদ করেনি।
আমি কি গলে গিয়েছিলাম? না, বরং আরও কঠোর হয়ে উঠেছিলাম।
তারপর থেকে দেখি—ঘরের সব কাজ নিখুঁতভাবে করে, কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো জবাব নেই। মনে মনে ভাবলাম, হ্যাঁ! নারীদের মাথায় তুলে রাখলে তারা বিগড়ে যায়, পায়ের নিচে রাখতে হয়। তাই সামান্য কারণ পেলেই তাকে শাস্তি দিতাম।
সময় গড়াল।
স্ত্রী যেন ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে গেল—
চঞ্চলতা হারাল, হাসি ভুলে গেল, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, কোনো আবেগ প্রকাশ করে না। সবকিছু নিঃশব্দে করে ফেলে।
একসময় মনে হলো, যেন একটা রোবট নিয়ে বাস করছি।
এক রাতে ঘুম ভেঙে দেখি, পাশে নেই সে।
ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও না ফেরায় উঠলাম খুঁজতে। দেখি, বারান্দায় জায়নামাজ বিছানো। রাত ৩:২৫ বাজে—তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়ানো সে।
আড়াল থেকে দেখি, সেজদায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে…
এই কান্না ছিল অন্যরকম। বুক চিরে ঢুকে যায়। এমন কান্না আগে কখনো ছুঁয়ে যায়নি আমাকে।
ঘরে ফিরে আসলাম—মন অস্থির। মাথায় শুধু ঘুরছে,
আল্লাহর দরবারে কী চাইছে সে এত কান্না নিয়ে?
পরদিন সন্ধ্যায় দেখি বারান্দায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
আমি গিয়ে চুপচাপ পাশে বসলাম।
আমাকে দেখে উঠে যেতে চাইলে বললাম,
— “যেও না… একটু বসো।”
সে কিছু না বলে বাধ্য ছায়ার মতো বসে পড়ল আমার পাশে।
আমি নরম গলায় বললাম,
— “তোমার কি আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আছে?”
সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “মানুষের কাছে এখন আর কোনো অভিযোগ করি না। সব অভিযোগ এখন আল্লাহর কাছে। তিনি চাইলে ঠিক করবেন, আর না চাইলে বদলে দিবেন।”
আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
— “কাল রাতে নামাজে এমন কী চাইছিলে যে এত কাঁদছিলে?”
সে তাকিয়ে বলল,
— “এক সময় ছিল, যখন আল্লাহর কাছে তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার গড়ার জন্য কাঁদতাম…
আর এখন ঠিক তেমন করেই কাঁদি—তোমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।”
তার এই কথাগুলো যেন কলিজা ছিঁড়ে দিল আমার।
এই পৃথিবীতে এমন বেদনাদায়ক কথা আমি আর শুনিনি।
তখনই বুঝে গেলাম—
নারীকে কখনোই কঠোরভাবে আয়ত্তে আনা যায় না।
ভালোবাসা আর সম্মানই পারে একজন নারীকে সবচেয়ে বেশি আপন করে তুলতে।
