বুদ্ধ মূর্তির ভেতরে হাজার বছরের প্রাচীন মমি!
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেদারল্যান্ডসের এমর্সফোর্ট শহরের মিয়ান্ডার মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় একটি হাজার বছরের পুরনো চীনা বুদ্ধমূর্তি। এটি ড্রেন্টস জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য ধার নেয়া হয়েছিল। ওটা ছিল সোনালি রঙে মোড়া এক শান্ত, পদ্মাসনে বসা বুদ্ধের মূর্তি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানতেন, এই মূর্তির ভিতর লুকিয়ে রয়েছে এক ভিন্ন রহস্য- একজন মমি অবস্থায় থাকা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর দেহ!
এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে ‘সবচেয়ে প্রাচীন রোগী’ হিসেবে অভিহিত করে মূর্তিটি আলতোভাবে স্ক্যানিং টেবিলে রাখা হয়। চীনা বৌদ্ধ শিল্প ও সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ এরিক ব্রুইনের তত্ত্বাবধানে রেডিওলজিস্ট বেন হেগেলম্যান সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে পুরো দেহ পরীক্ষা করেন এবং হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করেন ডিএনএ বিশ্লেষণের জন্য। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট রেইনাউড ভারমেইডেন একটি বিশেষ এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে মমিটির বুক ও পেট থেকে অভ্যন্তরীণ নমুনা সংগ্রহ করেন।
পরীক্ষার ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। মমির অভ্যন্তরীণ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং তার পরিবর্তে সেখানে রাখা হয়েছিল প্রাচীন চীনা হরফে লেখা কাগজ ও কিছু অজানা বস্তু। কীভাবে এই অঙ্গগুলো সরানো হলো, তার উত্তর এখনো অজানা।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, মূর্তির ভেতরে থাকা এই দেহটি ‘লিউকুয়ান’ নামের এক বৌদ্ধ গুরুর, যিনি সম্ভবত প্রায় ১০০০ বছর আগে মারা যান। মূর্তির ভিতরে বসে থাকা দেহটি ছিল কাপড়ে মোড়ানো এবং তার ওপর ছিল চীনা লিপিতে লেখা বার্তা। ধারণা করা হয়, লিউকুয়ান সম্ভবত নিজের ইচ্ছায় 'সেলফ-মমিফিকেশন' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যা নিজেকে জীবিত অবস্থায় ধীরে ধীরে মমিতে রূপান্তরের সাধনা।
এই স্ব-সংরক্ষণের প্রথা সর্বাধিক দেখা যেত জাপানে, কিন্তু চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এর উপস্থিতি ছিল। ‘লিভিং বুদ্ধাস’ বইয়ে কেন জেরেমিয়াহ লেখেন, এই সাধনায় আগ্রহী ভিক্ষুরা প্রায় এক দশক ধরে বিশেষ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতেন যার মাধ্যমে শরীরের চর্বি ও আর্দ্রতা হ্রাস করে সংরক্ষণে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করা হতো। তারা খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতেন চাল, গম ও সয়াবিন; খেতেন বাদাম, বুনো ফল, গাছের ছাল ও পাইন পাতার মতো উপাদান। সেই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া রোধে বিষাক্ত গাছের রস পান করতেন, যা শরীরে প্রাকৃতিক সংরক্ষণকারী তরল হিসেবে কাজ করত।
এই কঠিন অনুশীলনের পর, একসময় ভিক্ষুটি নিজেই নিজেকে জীবন্ত কবর দিতেন। জীবিত অবস্থায় মাটির নিচে চেম্বারে বসে থাকতেন, মুখে পাঠ করতেন বৌদ্ধ সূত্র। প্রতিদিন ঘন্টার শব্দ শুনে অন্যরা বুঝত তিনি বেঁচে আছেন। শব্দ বন্ধ হলে, তার দেহ চেম্বারে বন্ধ করে রাখা হতো। তিন বছর পর আবার খোলা হতো সেই কক্ষ। যদি দেহটি সংরক্ষিত থাকত, তবে তাকে মন্দিরে পবিত্র ‘জীবন্ত বুদ্ধ’ হিসেবে পূজা করা হতো; না হলে করা হতো পুনঃসমাধি।
অনেক বৌদ্ধ বিশ্বাস করেন, এসব মমি সন্ন্যাসীরা মৃত নন, বরং তাঁরা গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, যাকে বলা হয় ‘তুকদাম’। যদিও সেলফ-মমিফিকেশন খুব কম ক্ষেত্রে সফল হতো, তবু এর কিছু বাস্তব উদাহরণ পাওয়া গেছে। যেমন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মঙ্গোলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে গরুর চামড়ায় মোড়ানো এমন এক মমি অবস্থায় থাকা ভিক্ষুর দেহ আবিষ্কৃত হয়।