দুই হাত ধরে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, যেন তাদের পুরো শরীর বাতাসে ভাসছে। নিচে কোনো ভর না থাকায়, শরীরের ওজন ও মাধ্যাকর্ষণের টানে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে আসত।
বলছিলাম ১৮৭০-এর দশকের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে। তখন চিকিৎসা জগতে অনেক কিছুই ছিল অজানা। সেসময় সার্জারি মানেই ঝুঁকি, ব্যথা আর অনিশ্চয়তা। অ্যানেসথেশিয়া বা জীবাণুনাশক পদ্ধতি তখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এক সাহসী চিকিৎসক, ডঃ লুইস আলবার্ট সেয়ার, চিকিৎসা ইতিহাসে রেখে যান এক অসাধারণ পদচিহ্ন।
ডঃ সেয়ার ছিলেন আমেরিকার প্রথম দিককার একজন অর্থোপেডিক সার্জন-যিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতির মধ্যেই রোগ নিরাময়ের শক্তি লুকিয়ে আছে। তাঁর মতে, মাধ্যাকর্ষণ নিজেই মানুষের শরীরের ভেতরের বিকৃতি, বিশেষত শিরদাঁড়ার বাঁক, সোজা করার ক্ষমতা রাখে।
তাঁর ক্লিনিকে স্কোলিওসিসে (শিরদাঁড়া বাঁকা রোগ) আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এক অভিনব পরীক্ষা চলত। রোগীদের দুই হাত ধরে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, যেন তাদের পুরো শরীর বাতাসে ভাসছে। নিচে কোনো ভর না থাকায়, শরীরের ওজন ও মাধ্যাকর্ষণের টানে শিরদাঁড়া আস্তে আস্তে সোজা হতে শুরু করত।
ডঃ সেয়ার প্রতিটি পরিবর্তন মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন-শিরদাঁড়ার কোণ কতটা সোজা হলো, কোথায় টান পড়ছে, কতটা সময় ধরে ঝুলে থাকা নিরাপদ, সব তিনি নিজ হাতে মাপতেন।
এরপর এল তাঁর যুগান্তকারী উদ্ভাবন: “প্লাস্টার অফ প্যারিস জ্যাকেট।”
রোগী যখন সেই ঝুলন্ত, সোজা অবস্থায় থাকত, তখন ডঃ সেয়ার তার শরীরের ওপর ভেজা প্লাস্টার লাগিয়ে দিতেন। প্লাস্টার শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে তৈরি হতো এক ধরনের কঠিন, দেহের সাথে মানানসই জ্যাকেট, যা রোগীর শিরদাঁড়াকে সেই সোজা অবস্থাতেই ধরে রাখত।
প্রথম দিকের রোগীরা ব্যথায় কাতর হলেও, তাদের চোখে ফুটে উঠত এক নতুন আশার আলো। কারণ এতদিন স্কোলিওসিস মানেই ছিল লোহার ভারী ব্রেস, অচল শরীর, আর এক অনন্ত যন্ত্রণা। কিন্তু সেয়ারের প্লাস্টার জ্যাকেট তাদের মুক্তি দিল সেই কারাবাস থেকে। তারা আবার হাঁটতে, চলতে, এমনকি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেও পারছিল।
যদিও তাঁর পদ্ধতি আধুনিক দৃষ্টিতে ছিল কঠোর ও ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও এটিই আধুনিক অর্থোপেডিক চিকিৎসার সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়।