অধিকাংশ মানুষ জানেই না কতটা অসাধারণ পাখি পায়রা আসলে।
এই কোমল প্রাণীগুলো শুধু যে বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী তা-ই নয়—তারা বুদ্ধিমান, জটিল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাদের ঠোঁটের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ছোট ছোট চৌম্বক স্ফটিক, যেগুলো প্রকৃতির তৈরি GPS-এর মতো কাজ করে। এগুলোর সাহায্যে পায়রা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে এবং হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অবলীলায় নির্ভুলভাবে অতিক্রম করতে পারে। তারা এমন কম-কম্পাংকের শব্দ শুনতে পারে, যেগুলো মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে, আবার দিনের আলোতেই তারা দেখতে পায় মেরুবাতির (polarized light) গোপন সংকেত—যেন এক অদৃশ্য ভাষা।
তাদের বুদ্ধিমত্তাও চমকে দেওয়ার মতো। গবেষণায় দেখা গেছে, পায়রা গুনতে পারে, নিজেদের প্রতিচ্ছবি চিনতে পারে, বিমূর্ত ধারণা বুঝতে পারে, এমনকি সম্ভাব্যতার ধারণাও ধরতে পারে—কখনো কখনো ছোট বাচ্চাদেরও পেছনে ফেলে দেয় মানসিক পরীক্ষায়। আমরা যেখানে তিনটি রং দেখি, পায়রা দেখে চারটি, যার মধ্যে আছে অতিবেগুনি আলোও। ফলে তারা একে অপরের পালকে এমন সব নিখুঁত নকশা দেখে, যা আমাদের চোখে একেবারেই অদৃশ্য।
বাচ্চা লালনপালনের সময়, পায়রা তাদের গলায় তৈরি একধরনের দুধের মতো তরল দিয়ে খাওয়ায়—যেটি তারা শেয়ার করে ডাভ, ফ্ল্যামিংো আর এম্পেরর পেঙ্গুইনের সঙ্গেও। আর উড়তে গেলে? তারা ঘণ্টায় ৬০ মাইলেরও বেশি গতিতে দীর্ঘ সময় ধরে উড়তে সক্ষম।
তারা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে গড়ে তোলে আজীবনের সম্পর্ক। তবে আমাদের মতোই, পরিবেশগত চাপ তাদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। তাদের যোগাযোগব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত—ভিন্ন ভিন্ন কূজন ও ডাক দিয়ে তারা বোঝায় ভয়, প্রেম বা নিজের এলাকা। তারা দূর থেকেও পরিচিত পায়রার কণ্ঠস্বর চিনতে পারে।
ইতিহাসেও তাদের সাহসিকতার ছাপ রয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চের অ্যামি নামের এক পায়রা একটি বার্তা পৌঁছে দিয়ে ১৯৪ জন সৈন্যের জীবন বাঁচিয়েছিল—যদিও সে তখন তার একটি পা হারিয়ে ফেলেছিল।
দুঃখজনকভাবে, এত কিছু সত্ত্বেও, আমরা যেন ভুলেই গেছি আমাদের এই প্রাচীন সঙ্গীদের। এক সময় তারা ছিল আমাদের বার্তাবাহক, সহচর, সহযোগী—কিন্তু সময়ের চাহিদা ফুরালে আমরা তাদের ছেড়ে দিই। তবুও তারা আমাদের কাছাকাছি, শহরের ধারে ধারে রয়ে গেছে—কারণ মানুষের সান্নিধ্যই ছিল তাদের পরিচিত পরিবেশ।
তারা বেশি কিছু চায় না—কিছু ওটস, দানাদার খাবার, একটু পরিষ্কার পানি। কিন্তু তারা প্রাপ্য সম্মানটুকু পায় না। অবহেলা নয়, তাদের প্রাপ্য সহানুভূতি।
পায়রা কোনো কীটপতঙ্গ নয়। তারা বুদ্ধিমান, আবেগপ্রবণ, গভীরভাবে সামাজিক প্রাণী। তারা আমাদের মনে রাখে। সময় এসেছে, আমরাও তাদের মনে রাখি।