ছোটবেলায় সন্ধ্যা হলেই আমাদের বাড়ির উঠোন হয়ে উঠত এক রূপকথার রাজ্য। অন্ধকারে চারপাশের ঝোপঝাড়ের ভিতরে তারাদের তারাদের মতো করে জ্বলত লক্ষ লক্ষ জোনাকি। ওদের মিটমিটে আলোয় যেন প্রকৃতি নিজেই এক যাদুকরি উৎসবের আয়োজন করত। আমরা বন্ধুরা মিলে সেই আলোর খেলায় মেতে উঠতাম। কেউ বা নিঃশব্দে গাছের ডালে বসে থাকা জোনাকিদের দেখত, কেউ বা দুই হাতের তালুতে ধরে সেই জাদুর আলো অনুভব করত। আবার কেউবা সেই জোনাকি পোকা কাঁচের জারে ঢুকিয়ে ঘরে নিয়ে এসে মেতে উঠত আলোর নেশায়। জোনাকির ওই ক্ষণস্থায়ী আলোয় আমাদের শৈশব রঙিন হয়ে উঠেছিল।
আজ সেই দৃশ্য প্রায় বিলুপ্ত। শহর তো বটেই, এমনকি গ্রামের দিকেও জোনাকির ঝাঁক আর চোখে পড়ে না। আমাদের এই প্রজন্ম হয়তো শেষ প্রজন্ম, যারা জোনাকির আলোয় ভেসে যাওয়া সন্ধ্যা দেখেছে, সেই নীরব আলোক উৎসবের সাক্ষী হয়েছে।
কেন আজ জোনাকিরা হারিয়ে যাচ্ছে? এর পেছনে কারণইবা কি? এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। সবচেয়ে বড় কারণ হলো নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং আলোক দূষণ। জোনাকিরা সাধারণত এমন পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করে যেখানে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা এবং গাছপালা আছে। বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণে তাদের বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও, আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর কীটনাশক তাদের জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
তবে সবচেয়ে নীরব ঘাতক হলো আলোক দূষণ। শহরের উজ্জ্বল আলো জোনাকিদের যোগাযোগের পদ্ধতিকে বিঘ্নিত করে। জোনাকিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য, বিশেষত প্রজননের জন্য, আলোর সংকেত ব্যবহার করে। কৃত্রিম আলোর বন্যায় এই প্রাকৃতিক সংকেতগুলো হারিয়ে যায়, ফলে তারা সঙ্গী খুঁজে পায় না এবং তাদের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জোনাকিকে কেবল বইয়ের পাতায় বা পুরোনো দিনের ছবিতে দেখতে পাবে। তাদের কাছে জোনাকির আলোর গল্পটি শুধুই এক রূপকথা হয়ে থাকবে।
জোনাকিদের মিটমিটে আলো হচ্ছে প্রকৃতির এক অন্যরকম ভাষা। আমরা কি সত্যিই প্রকৃতির এই বিস্ময়কে রক্ষা করতে পেরেছি? এই প্রশ্নটি আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। জোনাকির আলো নিভে যাওয়ার অর্থ শুধু একটি প্রজাতির বিলুপ্তি নয়, বরং প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কের ফাটল।