চন্দ্রবোড়ার সত্য না জেনেই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে
***********************************************************************
সাপবিশেষজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে অতিকথন হচ্ছে। সত্য না জেনেই আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে, এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও দায় আছে। সাপের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে, কাউকে সাপে কামড়ালে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘রাসেলস ভাইপার: ভয় বনাম বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এ কথাগুলো বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন হলে মেডিসিন–বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটি এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সারা দেশের সরকারি উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অনলাইনে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।
আলোচকদের মধ্যে দু–একজন ওঝা রাখলে ভালো হতো—এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, কোনো ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না। সাপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ কাজ দুটি সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন সাংবাদিকেরা। তিনি বলেন, মানুষকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে—এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। দেশে সাপের কামড়ের রোগীর ওষুধ অ্যান্টিভেনমের কোনো ঘাটতি নেই।
অনুষ্ঠানের পরপর তিনটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। প্রথম উপস্থাপনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু রেজা বলেন, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বিষধর সাপের তালিকায় চন্দ্রবোড়া নেই। চন্দ্রবোড়ার চেয়ে দেশে কোবরার কামড়ে বেশি মানুষ মারা যায়। পানিতে চন্দ্রবোড়া থাকে এই ধারণা ভুল, চন্দ্রবোড়া খরাপ্রবণ এলাকায় বেশি থাকে। ভয় না পেলে, বিরক্ত না হলে, আঘাত না পেলে অন্যান্য সাপের মতো চন্দ্রবোড়াও মানুষকে কামড়ায় না। দেশে চন্দ্রবোড়া কামড়ালে তার চিকিৎসা আছে উল্লেখ করে এই সাপবিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে আতঙ্কিত হতে হবে।’
দ্বিতীয় উপস্থাপনায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মো. মাহবুবুর রহমান চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ালে রোগীর কী পরিস্থিতি হয় তার বর্ণনা করেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৩৫ রোগীর চিকিৎসা করেছেন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, সাপে কামড়ানো রোগীর ৬৭ শতাংশ ওঝার কাছে চিকিৎসা নেয়, ৩৩ শতাংশ চিকিৎসা নেয় হাসপাতালে। দেশে চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ পূর্ণ মাত্রায় কাজ করে না।
ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে চন্দ্রবোড়ার বিষের গুণের তারতম্য হয়। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ওষুধ মূলত ভারতের তৈরি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। ওই কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ গবেষণার অগ্রগতি তুলে ধরে বলেন, খুব শিগগির দেশের উপযোগী ওষুধ তারা তৈরি করতে সক্ষম হবেন। কাজটি আরও দ্রুত হবে যদি ৫০ লাখের মতো টাকা অনুদান বা সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয়।
তিনটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আলোচনায় অংশ নেন। এই পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিষয়ভিত্তিক পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, সাপের কামড় একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এটি জরুরি চিকিৎসার বিষয়। তিনি বলেন, অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা দরকার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ ফয়েজ। তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপারের ঘটনাটি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। চিকিৎসকদের দক্ষতা বাড়বে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে এবং ‘ওয়ান হেলথ’ বিষয়টি এগিয়ে নেওয়া যাবে।
অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, দেশে ৮০ থেকে ১০০ প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে বিষধর সাপ ১০ থেকে ১২ প্রজাতির। মানুষ যদি চন্দ্রবোড়ার হুজুগে সাপ মারা শুরু করে, তা হলে নতুন বিপর্যয়ের শুরু হবে। সাপ পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য দরকার। সাপের বিষ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ বলেন, কামড়টি বিষধর সাপের, নাকি নির্বিষ সাপের তা চিকিৎসকদের বুঝতে হবে। নির্বিষ সাপের কামড়ের রোগীকে বিষ নিরাময়ের ওষুধ দিলে বিপদ হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানা, বিএসএমএমইউর উপাচার্য দীন মোহাম্মদ নূরুল হক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ।
source : প্রথম আলো