একজন বোনের চমৎকার একটি লিখা
_____________________________________
আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, আমি জানতাম আমার ওপর আমার শাশুড়ির খেদমত করা ফরয নয়, এমনকি বলতে গেলে এটা আমার দায়িত্বও নয়। তারপরও আমি আমার সাধ্যমত তাদের খেদমত করেছি। শাশুড়ির পছন্দে রান্না করা সহ তাকে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দেয়া, তার উকুন বেছে চুল আঁচড়ে দেয়া, নখ কেটে দেয়া সবকিছুই করেছি আমার সাধ্যের ও বাইরে গিয়ে। শুধু শাশুড়ির-ই নয়, আমার ননদরাও বয়সে আমার মায়ের সমবয়সী ছিলেন, তারা বেড়াতে এলে আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। আজ সময়ের ব্যবধানে আমরা কেউ আর কাউকে একটি নজর দেখারও সুযোগ পাচ্ছি না। সে কষ্টের দিনগুলো (যেহেতু আমি বাবার বাসায় কোনো কাজ-ই করতাম না, তাই আমার জন্য ঐ দিনগুলো ছিল খুবই কষ্টের!) হয়তো হারিয়ে গেছে কিন্তু যা রয়ে গেছে তা হচ্ছে দো‘আ ও ভালোবাসা।
মনে আছে একদিন আমি রান্নাঘর থেকে ফিরে দেখি আমার দুই ননদ কিছু একটা নিয়ে হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই বড় আপা সরল উত্তর দিলেন, “শুনেছিলাম শিক্ষিত মেয়েরা বেয়াদব হয়, শশুর-শাশুড়ির খেদমত করে না, বড়দের সম্মান করে না। কিন্তু তুমি সেরকম না!” আমি তো লা জবাব! কী বলবো!! যা বলবো তা বলতে গেলে যদি কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলি?! শুধু বললাম “সত্যিকারের শিক্ষা তো মানুষকে বেয়াদব করে না, বরং আরও বেশি বিনয়ী করে..।”
আরেক দিনের ঘটনা, আমার বিয়ের পরপরই; আমার হাসব্যান্ড আমার জন্য ঢাকা থেকে একটা গিফট নিয়েছিল (সম্ভবত স্কার্ফ), আমার শাশুড়ি তখন বাসায়। আমি অবাক হয়ে গেলাম যে, আমার জন্য একটা গিফট আনলো অথচ মায়ের জন্য আনলো না, (মানুষটাকে তো আমি তখনও চিনিনি যে, একেকবার একেকজনের জন্য এনে অন্যদেরকে “সর্যি, তোমাদের জন্য এবার কিছু আনলাম না” বলাই ওর স্বভাব! এবং এখনও এরকমই! এরকমটা আমার মামা/চাচা/বাবাদের বেলায় কল্পনাও করা যায় না! আমি ওকে বললাম, আমি এটা এখন পারবো না, আগে মায়ের জন্য আনো...।” আমার নিজেকে তখন অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি জানি না ঘটনাটা ওর মনে আছে কি না, ওর অন্যদিকে ফিরে চোখ মোছাটা কিন্তু আমার দৃষ্টি এড়ায়নি!!.....
আমি বিয়ের পর যখন প্রথম স্কলারশীপের টাকা পাই, তখন সম্পূর্ণ টাকাটাই শাশুড়ি ও অন্যদের জন্য খরচ করি, গিফট করি। উনারা বললেন, “তোমার বাবা-মা তোমাকে পড়িয়েছেন, তাদের-ই তো হক্ব বেশি, আমি বললাম, “উনাদেরকে তো আগেও দিয়েছি, আপনাদেরকে দেয়ার জন্য আর পাবো কি না তা তো জানি না..।” সেই শাশুড়ি আমার এখন আর বেঁচে নেই, আমার ননদেরও এখন আর আমার বাসায় আসার সময়/সুযোগ নেই। যেটা আছে, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা, ভালো ধারনা!
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার শাশুড়িকে বোধহয় আমার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আজও মোনাজাতে এ চোখের পানি ফেলে তার জন্য দো‘আ করি। ঐ সামান্য খিদমতের বিনিময়ে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা-ই হয়তো এখনো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মনে আছে যখন প্রথম বাচ্চাটার জন্য রাতে ঘুমাতে পারতাম না, আমার শাশুড়ি মা ভোরে চুপি চুপি আমার ভাগ্নিকে ডেকে তুলতেন নাস্তা বানানোর জন্য, আমি টের পেলেই আমি উঠে যাবো, সেজন্য নিঃশব্দে কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। এরকম ভালোবাসা দেয়ার মত শাশুড়ি আমাদের ঘরে ঘরেই আছেন, আমরা সে ভালোবাসাটা আদায় করে নিতে জানি না শুধু! আমরা বাইরের মানুষগুলোর কাছে নিজেকে 'well mannered' প্রমাণিত করার জন্য কত স্যাক্রিফাইস-ই না করি, কিন্তু এই একটা প্রসঙ্গ এলেই কেন জানি নানা প্রশ্ন তুলি, ভীষণ নারীবাদী ও অধিকার সচেতন হয়ে উঠি! ইসলামের কোথায় লিখা আছে শশুর-শাশুড়ির খেদমত করা জরুরী নয় সে দলীল খুঁজি, অথচ আমাদের শাশুড়িরাও যে আমাদেরকে ভালোবাসেন, আমাদের সন্তানগুলোকে লালন-পালনে সহযোগিতা করেন, আমাদের অনেকেই জব করি বা বাইরে সময় দেই, সেক্ষেত্রে তারাই তো আমাদের সংসারটা সামলান। অন্তত দেখে রাখেন।
কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রমও থাকতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ঘরেই এখন এই দৃশ্যগুলোই চোখে পড়বে বেশি। তখন কিন্তু আর আমরা কুরআন-হাদীসের দলীল খুঁজি না যে, কোথায় আছে শাশুড়ি বৌকে রান্না করে খাওয়াতে হবে, কোথায় আছে বৌয়ের কষ্ট হবে বলে শাশুড়ি আর কোথাও যেতে পারবে না। এই বেলায় কিন্তু আমরা ঠিকই ‘মানুষের জন্য মানুষ’ -বুঝি। এই ক্ষেত্রে আমরা ঠিকই বুঝি ‘শাশুড়ি বৌয়ের কষ্ট না বুঝলে তিনি কিসের শাশুড়ি, তিনি মানুষ না!’ অথচ মাস শেষে বেতনটা হাতে পেলে আর আবার অধিকারবোধ জেগে উঠে, ১০ টাকার একটা চুলের ব্যান্ড কিনে দিতেও আমি রাজী না, কেন দিব শাশুড়ি কে, ‘আমার বেতনে কি শাশুড়ির হক্ব আছে?’ ...ইত্যাদি।
আসলে বর্তমান নীতি বিবর্জিত শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষালাভ করে আমরা coalfield হচ্ছি, মোটা বেতনে চাকুরী করার সুবাধে জামাইর কাছ থেকে হয়তো বাড়তি সম্মান (!) পাচ্ছি, কিন্তু ‘সত্যিকারের মানুষ হতে আর পারছি না’!!!